বিটকয়েন আয় করার উপায় : ধরাছোঁয়ার বাইরে যে মুদ্রা



বিটকয়েন: ধরাছোঁয়ার বাইরে যে মুদ্রা




কিছু মানুষ রয়েছে যারা “চাকরি নেব না, চাকরি দেব” এই মন্ত্রে বিশ্বাসী। আমার বন্ধু তাকী তাদেরই একজন। উদ্যেক্তা হিসেবে কিছু করার জন্য সে একাগ্রচিত্তে কাজ করে যাচ্ছে।
তাই, সারাবিশ্বে বিটকয়েন নিয়ে তোলপাড় শুরু হবারও আগে থেকেই সে বিটকয়েন নিয়ে কিছু একটা করার জন্য খুব আগ্রহী ছিল। কিন্তু বিটকয়েন নিয়ে একটু পড়ালেখা করে সে বেশ বিচলিত হয়ে গেল! বিটকয়েন নিয়ে আলোচনা, সমালোচনা এবং বিতর্কের কোন শেষ নেই! তাই, সে ধাপে ধাপে অগ্রসর হতে শুরু করল। প্রথমেই সে বুঝতে চাইল বিটকয়েন আসলে কী? 

১। বিটকয়েন কী:

বিটকয়েন তৈরি করা হয় ২০০৯ সালে। সাতোশি নাকামোতো নামক এক ব্যক্তিকে বিটকয়েনের স্রষ্টা বলা হয়। কিন্তু তাকী আশ্চর্য হয়ে দেখল যে এখনো পর্যন্ত উনার পরিচয় রহস্যাবৃত! তাকে এখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি!
অবশ্য, এরপর বিটকয়েনের দাম দেখে তাকীর উৎসাহ আরও বেড়ে গেল! সে নেট ঘেঁটে দেখতে পেল যে একটি বিটকয়েনের মূল্য ১৩,৩৮৩.৯০ ডলার। তবে এই দাম অনেক ওঠানামা করে। এরপর তাকী জানতে চাইল যে বিটকয়েন আসলে কীভাবে তৈরি হয়।

২। বিটকয়েন বিনিময় পদ্ধতি:

বিটকয়েনকে অনেক সময় পৃথিবীর সর্বপ্রথম ক্রিপ্টোকারেন্সি হিসেবে অভিহিত করা হয়। বিটকয়েনের মত ক্রিপ্টোকারেন্সির বিনিময় হয় কম্পিউটারের “peer to peer” নেটওয়ার্কের মাধ্যমে। এই নেটওয়ার্কের মুখ্য উদ্দেশ্যই হচ্ছে ডাটা শেয়ার করা। এই ডাটা হরেক রকমের হতে পারে। যেমনঃ চলচিত্র, গান, ডকুমেন্ট প্রভৃতি।
তাকী তখন কিছুটা দ্বিধায় ভুগতে শুরু করল। ডিজিটাল ডাটা নকল করা সম্ভব, তাহলে কি নকল বিটকয়েনও বানানো সম্ভব? কিন্তু তাকীর সেই দুশ্চিন্তা বেশিক্ষণ স্থায়ী হল না। বিটকয়েন ডিজিটাল মুদ্রা হওয়ার পরও যে কেউ চাইলেই নকল বিটকয়েন তৈরি করে জালিয়াতি করতে পারে না।
তার মূল কারণ হচ্ছে কোন ভিডিও বা অডিও ফাইলের মত বিটকয়েন চাইলেই নকল করা যায় না। আদতে বিটকয়েন ব্লকচেইন নামক একটি বিশাল বৈশ্বিক ডাটাবেজের একটি এন্ট্রি। ব্লকচেইন বিটকয়েনের সমস্ত বিনিময়ের হিসাব রাখে। এখন পর্যন্ত ব্লকচেইনে ১৪৮,৯৪৫ মেগাবাইট ডাটা জমা হয়েছে।
কিন্তু এই ব্লকচেইনের হিসাব কে রাখে? তাকী দেখেতে পেল যে যেহেতু বিটকয়েনের কোন নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ নেই, সেহেতু ব্লকচেইনের হিসাব রাখার জন্যও কোন স্বীকৃত কর্তৃপক্ষ নেই। বিটকয়েন একাউণ্ট(যাকে “ওয়ালেট” বলা হয়)-এর মধ্যে বিনিময়ের হিসাব রাখার কাজটি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষেরা করে থাকেন।
তাকী ঠিক করল সেও বিটকয়েন বিনিময়ের হিসাব রাখবে। সে প্রথমেই একটি বিশেষ ধরণের সমস্যা সমাধানকারী কম্পিউটার কিনে ফেলল। তারপর, নিজের বাসার ছাদে একটি শক্তিশালী সোলার প্যানেল বসিয়ে দিল। কারণ, এই কম্পিউটারগুলো ব্যবহার করতে প্রচুর বিদ্যুৎ শক্তি প্রয়োজন হয়। তাকীর পক্ষে বিদ্যুৎ বিল দিয়ে এই খরচ চালানো সম্ভব নয়। তার চেয়ে নিজস্ব সোলার প্যানেল দিয়ে সে অনেক অর্থ সাশ্রয় করতে পারবে।
এবার তাকী কম্পিউটারে বসে হিসাব রাখা শুরু করল। বিটকয়েনের যখন বিনিময় হয়, তখন বিনিময়কারীরা সেই বিনিময়ের ঘোষণা দেন এবং তাকীর মত হিসাবরক্ষকেরা ব্লকচেইনে সেই তথ্যটি হালনাগাদ করে।
অনেকে একই তথ্য হালনাগাদ করার ফলশ্রুতিতে দেখা যায় যে কেউ যদি জালিয়াতি করার চেষ্টা করে, সেই চেষ্টা ধরা পড়ে যায়। তথ্য হালনাগাদ করতে করতে তাকীর প্রথম ব্লক যখন পূরণ হয়ে গেল, তখন সে নতুন ব্লক ব্যবহার করা শুরু করল। এভাবে একের পর এক ব্লক ব্যবহার করে তাকী তথ্যের ব্লকচেইন বানাতে লাগল।
তাকী ব্লকচেইন হালনাগাদ করার সময় বিটকয়েন বিনিময়ের তিনটি বিষয়কে লিপিবদ্ধ করে থাকে। যথাঃ
১। প্রেরকের ওয়ালেট নম্বর
২। প্রাপকের ওয়ালেট নম্বর
৩। কয়টি বিটকয়েন পাঠানো হচ্ছে
কিন্তু এত মানুষের কাছে একাউন্ট নম্বরের তথ্য থাকা তাকীর কাছে ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে হল। যে কেউ চাইলেই আরেকজনের বিটকয়েন ওয়ালেট থেকে নিজের ওয়ালেটে বিটকয়েন পাঠিয়ে দিতে পারে।
একদিন টিএসসিতে চা খেতে খেতে এই ঝুঁকির কথা সে নাহিয়ান ভাইকে বলল। তখন নাহিয়ান ভাই ওকে বললেন, “এই ঝুঁকি এড়ানোর জন্যই ক্রিপ্টোগ্রাফি ব্যবহার করা হয় এবং এজন্যই বিটকয়েনকে একটি ক্রিপ্টোকারেন্সি বলা হয়।”
তাকী: “কিন্তু ভাই, এই ক্রিপ্টোগ্রাফি কীভাবে কাজ করে?”
নাহিয়ান ভাই: “বিটকয়েনের ওয়ালেটের ক্ষেত্রে দুইটি চাবি/কী ব্যবহার করা হয়। একটি হচ্ছে প্রাইভেট কী এবং অপরটি হচ্ছে পাবলিক কী। এই চাবি দুইটি অনন্য এবং এর দ্বারাই বিটকয়েনের বিনিময়ের সুরক্ষা নিশ্চিত করা হয়। ধরা যাক, আমি বিটকয়েনের ডাটা পাঠাব, প্রাইভেট কী দিয়ে আমি সেই ডাটা চিহ্নিত করে দিব।
পরবর্তীতে আমার পাবলিক কী দিয়ে ডাটাটি যাচাই করা হয়, যদি প্রাইভেট কীর চিহ্ন এবং পাবলিক কীর চিহ্ন মিলে যায়, তাহলে সবাই বুঝতে পারবে যে ডাটাটি আসলেই আমি পাঠিয়েছি। এই দুইটি চাবির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে ক্রেডিট কার্ড নাম্বার অথবা স্বাক্ষরের মত এটি নকল করা যায় না।”
তাকী: “বাহ! যাক, দুশ্চিন্তা মুক্ত হলাম!”

৩। বিটকয়েন তৈরির উপায়:

তাকীর মত হিসাবরক্ষকেরা বিটকয়েনের ব্লকচেইনের হিসাব রাখার কাজটি অনেক সময়, অর্থ এবং শ্রম দিয়ে কাজটা করে। এর পেছনে তাদের সবারই একটি বিশেষ উদ্দেশ্য রয়েছে। ব্লকচেইনে নতুন একটি ব্লক যোগ করার জন্য একজন হিসাবরক্ষক ১২.৫ টি বিটকয়েন লাভ করেন।
যারা এই কাজটি করেন, তাদেরকে “miner” বলা হয়। কারণ, তারা স্বর্ণখনি থেকে স্বর্ণ উত্তোলনের মতই কম্পিউটারে বসে বিটকয়েন উত্তোলন করেন। কেবল মাইনারদের পুরস্কৃত করতেই বিটকয়েন তৈরি করা হয়।

৪। বিটকয়েনের দুষ্প্রাপ্যতা:

তাকী প্রথম ব্লক যোগ করে ১২.৫ টি বিটকয়েন পেয়ে খুব খুশি হয়ে গেল। কিন্তু তার খুশি বেশিক্ষণ বজায় থাকল না। কারণ, প্রথম দিকে একটি ব্লক ব্লকচেইনে যোগ করার জন্য ৫০ টি বিটকয়েন দেয়া হত। কিন্তু প্রতি ২১০,০০০ ব্লক ব্লকচেইনে যোগ হলে পুরস্কৃত বিটকয়েনের সংখ্যা অর্ধেকে নেমে আসে।
তাই, পরবর্তীতে ৫০ থেকে ২৫ টি বিটকয়েন এবং বর্তমানে ১২.৫ টি বিটকয়েন পুরস্কার হিসেবে দেওয়া হয়। ভবিষ্যতে পুরস্কৃত বিটকয়েনের সংখ্যা এভাবেই আরো কমতে থাকবে। বিটকয়েনের নীলনকশা এমনভাবে করা হয়েছে যার ফলে বিটকয়েনের যোগান হবে সুনির্দিষ্ট এবং সীমিত।
বিভিন্ন হিসাব অনুযায়ী, ২১৪০ সালে সর্বশেষ বিটকয়েনটির সৃষ্টি হবে।
এই সীমিত এবং সুনির্দিষ্ট যোগানই বিটকয়েনকে করে তুলেছে এত মূল্যবান। ভবিষ্যতে বিটকয়েনের মূল্য কেমন হবে, কতদিন এই উচ্চহার  বজায় থাকবে, সেটা নিয়ে তুমুল মতবিরোধ রয়েছে।
এত অনিশ্চয়তার মাঝে তাকী ঠিক কী করবে, তা এখনো বুঝে উঠতে পারছে না! তাকী সামনে কী করবে এবং বিটকয়েনের ভবিষ্যৎ কী হবে, সেটি নিয়ে আগামী দুটি লেখায় আলোকপাত করার চেষ্টা করবো।
তবে নিঃসন্দেহে বলা যায়, বিটকয়েন অর্থনীতি এবং প্রযুক্তির ক্ষেত্রে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করে দিয়েছে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ